ভৌতিক গল্পঃ অভিশপ্ত নদী | সেবিন মিয়া
কূপতলা শহর থেকে প্রায় বাইশ কি.মি. দূরে ছোট্ট একটি পাড়া গাঁ। খুব অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে গ্রামটির পথচলা। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঝখানে কয়েকটি ছোট ছোট ঘর আর সুউচ্চ গাছপালা নিয়ে প্রকৃতির বুকে স্বগর্বে দাড়িয়ে আছে গ্রামটি।গ্রাম ভেদ করে এঁকেবেকে চলেছে কাঁচা রাস্তাটি। গারোয়ালের ভাটিয়ালি গান আর কৃষকের হালের ফলা যেন গ্রামটিকে সর্বদা নতুন রুপ দিয়ে চলেছে। গ্রামের পাশ কেটে চলে গেছে বাঙ্গালী নদী।এ যেন প্রকৃতির এক অপরুপ সৃষ্টি।
অপরুপ এই গ্রামটির নামকরণ নিয়েও অনেক গল্প শোনা যায়।
শত শত বছর কয়েকটি বড় কূপ নিয়ে পড়ে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এই জায়গাটি।
যমুনা নদীর তীরবর্তী কিছু ঘর প্রবল বন্যা এবং ভূমিধ্বসে অতল গভীরে নিপতিত হলে ভিটেহারা অসহায় মানুষগুলো পতিত জমি ভরাট করে বসতি গড়ে তুলে।
এছাড়া আরও একটি ঘটনা বিদ্যমান। এককালে কোন এক গ্রামের বড় সাব সেখানে গোসল করতে এলে এক অশরীরী আত্মার প্রভাবে তার একটি পা বিকলঙ্গ হয়ে যায়। সেই হতে এই গ্রামের নাম কূপতলা।
হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ে গ্রামটি গড়ে ওঠেছে।
সমরেশ ও জহির এগাঁয়েরই বাসিন্দা। ধর্ম ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে নিবিড় সম্পর্ক। একে অন্যের খুব কাছের মানুষ।
জহির খেটে খাওয়া কৃষক।
সমরেশ পেশায় জেলে। নদী তার আশ্রয়কেন্দ্র। অন্ধকার রাত তার অতি আপন।খরো রোদ্দুরে সারাদিন নদীর পানি উত্তপ্ত থাকে ফলে মাছ তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না।তাই রাতের আধারে ছুটতে হয় সমরেশকে।যদিও এ নদীর ভয়ঙ্কর রুপের কথা সবারই জানা ।
রাতের আধারে নদীতে যাওয়া জহিরের কাছে পছন্দীয় নয়। কার না জীবনের মায়া আছে!! সমরেশ যে বড্ড নিরুপায়। পরিবারের মুখে দু-চারটে ভাত তুলে দিতে শত বাধা-বিপত্তিকে তাচ্ছিল্য করে ছুটতে হয় ভয়াল ঔ নদীর পানে।
নদীটা খুব চওড়া নয়। চৈত্র মাসে এর অনেকাংশ শুকিয়ে যায়।তখন সমরেশকে একধাপ ফোর গুনতে হয়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে নদী তার ভরা যৌবন ফিরে পায়। সেই সাথে সমরেশেরও মন ভরে উঠে। সমরেশের মনের অভিপ্রায়, "যদি সারাজীবন নদীটা ভরা যৌবনা থাকতো তাহলে হয়তো তাকে খুব একটা টানাপোড়ন সইতে হতো না।
শমরেশ রাতে আর জহির দিনে কাজ করে তাই তাদের খুব একটা গল্প করার ফুসরত হয় না। তাই জন্য জহির মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে অন্ধকারে বন্ধুর সাথে সঙ্গ দিয়ে মনটাকে চাঙ্গা করে।
পাড়ার বুড়োদের কাছে এ নদীর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানা যায়।
অনেকদিন আগের কথা, এগ্রামে মাজেদ নামে এক জেলে ছিল। সমরেশের মতোই নাকি তার মাছের নেশা ছিল। একরাতে মাছ ধরতে গেলে তিনি এক ছদ্মবেশী পেত্নীর খপ্পড়ে পড়ে। অবশেষে ভোরে গ্রামের অদূরে হিজলা গাছের কাছে তার ছেঁড়া রক্তাক্ত শরীর উদ্ধার করে গ্রামবাসী। অনেক দিন এর প্রকপটতা থাকলেও এখন আর সে কথাগুলো কেউ কানে তুলে না।
আজকাল জহিরের কাজ-কর্ম কমে গেছে। প্রায়ই তাকে ঘরে থাকতে হয়। তাই চিন্তা করল সমরেশের সাথে ঘুরে আসা যাক নদী থেকে।তৎক্ষণাতই ছুটে গেল শমরেশের বাড়ি। দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সমরেশের সংসার। সারাবছর অভাব লেগেই থাকে সংসারে। নিত্যা দিন কার মতো পান্তা ভাতে মরিচ নিয়ে মধ্যাণ্য ভোজনে বসেছে সমরেশ।তড়িঘড়ি করে চৌকি এগিয়ে দিল মধুরানী।জহির মিয়া একখানা পানের আবদার করে চৌকিতে ঠেস দিয়ে বসে সমরেশের সাথে আলাপে উদ্যত হলো।“ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে, কাজ কর্মে বেশ মন্দাভাব চলছে। তাই চিন্তা করলাম আজ নদীতে যাবো তোমার সাথে" বলল জহির।
"আরে সে তো বেশ ভালো কথা। তোমার সাথে অনেকদিন যাবত বেশ ভালো করে গল্প জমে উঠে নি। আজ একটা ভালো সুযোগ হবে।"উত্তর করল সমরেশ।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে জহির বলল তাহলে এখন উঠি। "তুমি আগেই যেইও। আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে, হাক ছেড়ে তোমাকে খুঁজে নেবো,সজাগ থেকো।" বলে চলে গেলো জহির।
এশার আজান হয়ে গেছে। সমরেশ তার জালগুলো গুছিয়ে নিল। মধুরানী একটা পুটলিতে খাবার বেঁধে আনলো। জহির যাবে নদীতে তাই পুটলিটা বেশ বড় হয়েছে আজ। সমরেশের বিড়িহীন এক মূহূর্ত চলে না। ছোট মেয়ে এক প্যাক বিড়ি আর দিয়েশলাই দিয়ে গেল। মেয়েটির গালে চুমু দিয়ে তা কোমরে গুজে নিল সমরেশ।
ঘর থেকে বের হতেই মধুরানী সিল নিয়ে প্রস্তুত। প্রাচীনরীতি, মাছ ধরতে যাওয়ার পথে ঢিল ছুড়লে নাকি অনেক মাছ পাওয়া যায়।সকল কার্য শেষে বিদায় নিয়ে শমরেশ হাঁটতে শুরু করলো।
একক্রোশ পথ।সমরেশ হাঁটতে লাগলো আনমনে।বাঁশঝারের পাশ কেটে নদীপথ। হঠাৎ একটি কালো বিড়াল দৌড়ে এসে তার পায়ে বেড়ি কাটতে লাগলো।কালো বিড়াল শুভ নয়। পথে বাঁধা-বিপত্তির সম্ভাবনা থাকে। বাম পায়ে লাথি দিয়ে তাড়ালো বিড়ালটাকে।অবশেষে পৌছিল নদীর তীরে।
আজ কেমন জানি নদীটা শান্ত। কোথাও কোনো নৌকার দেখা নেই জনমানবের আনাগোনা নেই। মাঝে মাঝে শুধু নদীর গতিবেগের ছল ছল ধ্বনি কর্ণগোচর হলো। একরাশ ভীতি তার গা ছাপিয়ে চলে গেল!! ফিরে যাবার মত করল। জহির আসার অভিপ্রায়ে আবার থেমে গেল সমরেশ।
ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আস্তে আস্তে নৌকার গলুইয়ের উপর বসে পড়লো সমরেশ;নদীটাও যেন আজ তার সাথে বৈপরীত্য করে চলছে।
ঠান্ডায় হিম হয়ে গেছে তার শরীর।নদীর মাঝ বরাবর জালটা ফেলে গোছ থেকে বিড়ি বের করলো।ছইয়ের নিচে টিপ টিপ করে জ্বলছে লন্ঠন।বিড়ি ধরিয়ে লন্ঠনের আগুনে ঠান্ডা হাত গরম করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো সমরেশ। আনমনে আজ যেন কত কি-ই না ভাবছে সমরেশ।স্বপ্নের মায়াজালে বাঁধা এই দেহখানা কতটি বছর পারি দিল। না জানি আরও কত স্বপ্ন ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে পার হবে, সে এক বিশাল অধ্যায়। টিপ টিপ করে জ্বলা লন্ঠনের মতোই যেন তার আশাগুলো জ্বলছে তার মনের কোণে। কবে যে প্রজ্বলিত হবে তার কোন হদিস মিলে না।ভাবতে ভাবতে দেহ নিথর হয়ে এলো।পৃথিবীর সমস্ত ঘুম যেন আজ তার চোখে।চোখের পাতা টেনে তোলার জো নেই।অক্লান্ত মন আজ ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য নেতিয়ে পড়লো নৌকার উপর।
রাত প্রায় বারোটা। নদীর তীর হতে একটা চেনা গলা ভেসে এলো। কর্ণগোচর হতেই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলো সমরেশ।
তীর হতে জহির হাঁকছে, "সমরেশ দাদা ও সমরেশ দাদা, আমি জহির, আমারে নিয়ে যাও।"
সমরেশের ভীতি যেন অনেকাংশেই কেটে গেল।
প্রত্যুত্তরে বলল, "দাঁড়াও জহির ভাই আমি আইতাছি"
জলদি বৈঠা চালিয়ে পৌছিল নদীর তীরে। আমিতো ভাবলাম তুমি আর আসবে না! তাই শুয়ে শুয়ে নানান কথার হালনাগাদ করছিলাম,যাক ভালোই হলো তুমি এসে!তা তোমার হাতে কি ওগুলো??
"আর বলো না দাদা তোমার বৌদি পিঠা তৈরি করছিল।শুকনা জিনিস, আনতে নিষেধ করলো! যেখানে তুমি আছো সেখানে কি আর ডর আছে?" বলতে বলতে জহির নৌকার উপর গিয়ে বসলো।
না আনলেই পারতে,শুকনা জিনিস তার মধ্যে আবার পূর্ণিমা রাত!!
“ভয় পেয়ো না তো, চলো তোমার গন্তব্যে চলো।পূর্ণিমা রাত মাছ বেশ ভালোই পাওয়া যাবে! কি বলো সমরেশ দা??”বলল জহির।
মাথা নারিয়ে সম্মতি দিল সমরেশ।
চলো গিয়ে দেখি জাল তোলা যাক,প্রায় দু'ঘন্টা হয়ে গেলো জাল তোলা হয় নি।
গন্তব্যে পৌঁছে দেরি না করে জাল টানতে শুরু করলো সমরেশ ও জহির। সম্পূর্ণ জাল উপরে উঠলে অবাক হয়ে গেল সমরেশ!! হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ!
কি ব্যাপার সমরেশ দা অমন তাকিয়ে রইলে যে?
ঘোর কাটিয়ে উঠে উত্তর করলো, জানো জহির ভাই এবছরে এমন মাছ বাজতে দেখিনি! পরক্ষনেই সমরেশ বেশ উৎফুল্ল স্বরে বলল, "তোমার ভাগ্যটা অনেক ভালো জহির ভাই।"
কি যে বলো দাদা? ভাগ্য ভালো হলে কি আর কুঁড়ে ঘরে রাত কাটাই? পূর্ণিমা রাত তাই জন্য এমনটি।
"তা হতে পারে বৈকি!" উত্তর করলো সমরেশ।
গল্পে গল্পে রাত আরো গভীর হতে লাগলো।সময়ের দিকে কারও খেয়াল নেই।
নৌকা বয়ে চলেছে অবিরত!
লন্ঠনের তেলও ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। অদূরে কোন নৌকা চোখে মেলে না।কারও সাজ ঘরের বাতিও চলে না। পাখিরা তাদের ছোট্ট কুটিরে নির্জনে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু স্রোতস্বিনীর স্রোত বয়ে চলেছে দক্ষিণপানে।
এতক্ষণ চাঁদের আলো নদীর জলে প্রকট ছিল। আস্তে আস্তে তা ক্ষীণকায় হতে লাগলো। চাঁদ যেন তার নিত্যকার কার্য শেষে গায়ে চাদর টেনে বিশ্রামে যাচ্ছে।
রাত্রি প্রায় দুইটা। এতক্ষণে সমরেশের হুঁশ হলো। এ আমি কোথায় চলে এলাম? সামনে তিন নদীর মোহনা।নদীর তীর ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড ভয়ানক সেই হিজল গাছ এক নিমিষেই সমরেশ আতঙ্কিত হয়ে উঠলো।
জহিরকে ডেকে বললো, ভাই চেয়ে দেখো আমরা কোথায় চলে আইছি! যেখানে মাজেদের রক্তাক্ত -ছেঁড়া শরীর পাওয়া গিয়েছিল! চলো আমরা বাড়ি ফিরে যায়??
জহির বেশ সাহসিকতার সাথে তাকে অভয় দিয়ে বললো, মিছেমিছি ভয় করছো, আমি ও সব ভূত প্রেতে ভয় পাই না।
সমরেশের মনে খটকা লাগতে শুরু করেছে।এর আগে জহির তাকে নদীতে আসার জন্য বিভিন্নভাবে নিষেধ করতো সেই কিনা আজ তাকে অভয় দিচ্ছে।
চারিদিকে অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো।অনেক পিরাপিরি করেও জহিরকে ফেরাতে পারলো না সমরেশ। বাধ্য হয়ে সঙ্গ দিতে হলো।
রাত তিনটা। চন্দ্র সম্পূর্ণ গা ঢাকা দিয়েছে। চারিদিকে কালো ঘন অন্ধকার।জলরাশিটুকুও দেখবার উপায় নেই। জহির তার গল্প বন্ধ করেছে। সমরেশের অস্বস্তি লাগছে।
টিপ টিপ করে জ্বলা লন্ঠনটুকু ধুপ করে নিবে গেল।শান্ত জলে উত্তাল ঢেউ সঞ্চারিত হলো। চারিদিকে ঝরো হাওয়ায় নৌকার পাল ছিড়ে যাবার উপক্রম। সমরেশ প্রচন্ড ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে জাল টানতে টানতে জহিরকে ডাকলো।
প্রত্যুত্তরে কোন সাড়া - শব্দ নেই।
সমরেশ অন্ধকারে উবু হয়ে জাল টানতে পিছনে ভয়ঙ্কর শব্দ উপলব্ধি করলো। কেউ যেন হার চিবিয়ে চলেছে অবিরত।
সমরেশের আর বুঝতে বাকি রইল না যে সে একটা ছদ্মবেশী পেত্নীর খপ্পরে পড়েছে। হাত থেকে জালটা পড়ে গিয়ে নিমিষেই নদীর অথৈ জলে হারিয়ে গেল।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পিছনে ফিরে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো সেই বিবর্ণ বিশ্রী চেহারা। সারা শরীর রক্তে মাখা, ফলার মতো দাঁত, মুখের ক্ষতবিক্ষত কাটা ঘা থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝড়ছে।
"সমরেশ করজোড়ে বিনয় করতে লাগলো। এবারের মতো আমায় ছেড়ে দাও!!! আমার অপেক্ষায় চেয়ে রয়েছে আমার পরিবার "বলতে বলতে মূর্ছা গেল সমরেশ।
ভোরে ঘুম থেকে উঠেই জহির ছুটে চললো সমরেশের বাড়ি।সমরেশ বাড়ি ফিরেছে কি-না তা জানতে। রাতে কাজের চাঁপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল জহির। তাই নদীতে যেতে পারে নি।
খবর নিয়ে জানা গেল সমরেশ এখনো বাড়ি ফিরে নি।জহির ছুটে চললো নদীর পানে।বেশ কয়েক বার হাঁক ছেড়ে সাড়া না পেয়ে ছুটলো হিজল গাছের দিকে।
জহিরের চক্ষু কপালে উঠে গেল!
হিজল গাছের নিচে নৌকার গলুইয়ের উপর পড়ে আছে সমরেশের ভয়ানক রক্তাক্ত দেহখানি।
সামান্য কিছু দানের মাধ্যমে প্রতিদান দিতে হলো একজন স্বপ্নদ্রষ্টা অভিভাবককে। হাজারো স্বপ্নের স্রষ্টা নিপতিত হলো দুর্নিলিপ্ত নদীর পিশাচ গর্ভে
।
সেই থেকে আর কেউ সেখানে মাছ ধরতে যায় নি!