সমসাময়িক গল্পঃ 'নামটা দেস বাবা' | তিতাস সরকার
'এ বাবা মোর নামটা অ্যানা দেস বাহে- আল্লা তোর ভালো করবে'- স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধির কাছে আকুতি করে বলছেন অসহায় ভিখারি আফিদা বেগম।
ভিক্ষা করে যেটুকু পায় মানুষের দ্বারে দ্বারে- তাই দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে আছে সে। বয়স আটষট্টি বছর। কিন্তু তার দিকে তাকালে মনে হবে শত বছর বুঝি ছুঁই ছুঁই। দুই ছেলের ভাগাভাগির বলি হয়ে অবশেষে এই বৃত্তি বেছে নিতে হয়েছে তাকে। ঠিকঠাক না খেতে পেয়ে তার আজ চেহারার এই হাল। শরীরের চামড়া ঢিলে হয়ে গ্যাছে। একটা দাঁতও নেই কোনোকিছু চিবানোর মতো।
করোনা ভাইরাস কী- তার তা অজানা। শরীরে জড়ানো ছেঁড়া ওড়নাটা মাথা ও মুখে ঢেকে লাঠিতে ভর করে আশেপাশের দু'চার বাড়িতে দু'টো চাল জোগাড় করে সে।
আগে তারপরও আশেপাশের গাঁয়ে যেতে পেরেছিলো সে। এখন আর তার উপায়ও নেই। করোনার জন্য ঘর থেকে বেড়োনোই যেখানে দুষ্কর সেখানে আরেক গাঁয়ে যাবার কথা চিন্তাও করা মানা। প্রশাসনের কড়া নজরদারি।
কিন্তু, পেটের জ্বালা কী আর সেই বাঁধা মানে!
একদিন বাজারে একটা মাছ কিনতে এসে হঠাৎ দ্যাখা স্থানীয় ইউপি সদস্যের সাথে। কয়েকদিন থেকে আফিদা বেগম ভাবছেন একটা মাছ কিনবেন। মাছ খান না অনেকদিন হলো।
অনেকদিন হলো আফিদা বেগম শুনছেন যে, সরকার গরীব ও অসহায় মানুষদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছেন।
আজকে মেম্বারের দ্যাখা পেয়ে তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করছেন একটা কার্ড করে দেয়ার জন্য।
ইউপি সদস্য তার সাথের ছেলেটাকে ভিখারিনী আফিদা বেগমের নামটা লিখে নেয়ার জন্য বলে স্থান ত্যাগ করলেন।
এদিকে ইউপি সদস্যের সাথে আসা ছেলেটা আফিদা বেগমকে চুপিসারে বলল, 'চাচী, ২০০ টাকা দেওয়া লাগবে। তাছাড়া হবে না।'
আফিদা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার কাছে অনুনয় করে বলল, 'বাবা, মুই গরীব মানুষ, ভিক্ষা করি খাম। ট্যাকা কোনটে পাম বাবা। মোক অ্যাকনা কাট (কার্ড) করি দে বাবা- তোর ভালো হোবে।'
ছেলেটা তার কথায় কান দিলো না। ২০০ টাকা তার চাই-ই।
আফিদা বেগম তার তার অনেক কষ্টে জোগানো মাছ কিনতে আনা আশি টাকা আঁচলের কোনা থেকে বের করে তার হাতে তুলে দিলো।
ইউপি সদস্যের সেই চ্যালা ছেলেটি তাকে বাকি টাকা ত্রাণ নেয়ার দিন দিয়ে দেয় সে কথা বলে তার নামটা লিখে নিয়ে যায়।
আফিদা বেগমের আর মাছ খাওয়া হলোনা।
আজকে ত্রাণ দিচ্ছে স্কুল মাঠে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়েই রওনা দিলেন স্কুল মাঠের উদ্দেশ্যে।
অনেকক্ষন ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। অনেকেই ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন।
আফিদা বেগমের নাম এলোনা।
ত্রাণের প্যাকেটে দশ কেজি চাল, ১ লিটার সয়াবিন তেল, ১ টা সাবান, ১/২ কেজি ডাল, ২ কেজি আলু, ২৫০ গ্রাম মরিচ।
অনেকক্ষন অপেক্ষা করেও আফিদা বেগম কিছু না পেয়ে মুখ শুকনো করে ঘরে ফিরলেন।
সারাদিন কিছু খায়নি সে। শরীরে প্রচন্ড জ্বর।
ত্রাণ না পেয়ে মন খারাপ বলে রাতেও ভাত রাধেনি সে। পাশের বাড়ির রহিমের বউ কয়েকটা শুকনো মুড়ি দিয়েছিলো পরশু। তাই খেয়ে মনে কষ্ট নিয়ে শুয়ে পড়লো আফিদা বেগম।
মনে কষ্ট তবুও ছেলেটিকে গালি দিলোনা সে। একবুক কষ্ট নিয়েই দুহাত তুলে প্রার্থনা করলো- 'আল্লাহ তোর ভালো করুক বাবা!'
রাত শেষ হলো। সবাই ঘুম থেকে উঠলো।
চৌকিদারের দ্বারা ইউপি সদস্য আফিদার বাড়িতে ত্রাণ নিয়ে হাজির খুব সকালেই।
চৌকিদার এসে ভিখারি আফিদা বেগমকে ডাকছে- 'চাচী- এই যে তোমার চাউলের ব্যাগ- ওঠো! ও চাচী, চাচী!'
আফিদা বেগমের ঘুম আর ভাঙলো না।
অনেক ডাকাডাকি করেও যখন ঘুম ভাঙছে না তার- দরজা ভেঙে ছেলেরা ঢুকে দ্যাখে তাদের মা আর বেঁচে নেই।
মুহুর্তেই কান্নার রোল পড়ে গ্যালো।
চৌকিদার ত্রাণের প্যাকেটটি আঙিনায় রেখে চোখ মুছতে মুছতে ডিউটিতে চলে গেলেন!