বিজ্ঞাপন

ঈদুল ফিতরঃ উদযাপনের সংস্কৃতি ও খাদ্য উপাদান | মীম মিজান








প্রত্যেক ধর্ম-বর্ণ, গোত্র-জাতির নিজস্ব কিছু উৎসব আছে। সকল গোত্র সেই সকল স্বকীয় উৎসব পালনে অনুভব করে আনন্দ। তবে সব উৎসবের আনন্দ উৎযাপন নির্মল নয়। আমরা মানবজাতি হিশেবে এক। তবে ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আছে বিভেদ। পৃথিবীর প্রায় ৮০ কোটি মানুষ যে পবিত্র ধর্মটি পালন করেন তার নাম ইসলাম। আর এই ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ একটি জীবন বিধান। যে জীবন বিধানের প্রত্যেকটি অংশ নির্মল, শালীন ও বিজ্ঞানসম্মত। আমরা সকলেই জানি যে, আমাদের জীবন বিধানে দু'টো নিস্কলুষ ও পবিত্র উৎসব আছে। সে দু'টো হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। চলতি বছর ইনশা আল্লাহ আমরা পালন করতে চলেছি ১৪৩৮ তম ঈদুল ফিতর। 



'ঈদ' আরবি শব্দ 'عید' এর প্রতিবর্ণীকরণ। (যদিও সম্প্রতি বাংলা একাডেমি প্রতিবর্ণী করণের সময় একটি বিতর্ক সৃষ্টি করে 'ইদ' নামকরণ করেছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নব্য চালুকৃত 'ইদ' শব্দের আরবি অর্থ হচ্ছে ঋতুবর্তী মহিলা। আমরা জোর দাবী জানাচ্ছি বিষয়টি পুনঃ বিবেচনার জন্য।) অর্থ আনন্দ, উৎসব পর্ব। আর ফিতর ও আরবি শব্দ 'فطر' এর প্রতিবর্ণীকরণ। অর্থ ভাঙ্গা, চিড়, ভাঙ্গন। এদিক হতে ঈদুল ফিতর অর্থ হলো রোজা ভাঙার পর্ব বা উৎসব। বিখ্যাত আরবী অভিধান 'আল মাওরিদ' এ ঈদ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে ভোজ, ধর্মোৎসব, পর্ব, তীব্র আনন্দ, ভূরিভোজন করা, ভোজ দেওয়া, ভূরিভোজন করানো, পরিতৃপ্ত করা ইত্যাদি।

আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য দাওয়াত। বিধায় ঐদিন হলো ভূরিভোজনের সুযোগ, বেশী বেশী করে খাওয়ার দিন, রোযা না রাখার দিন। পরিভাষায় এটিকে ‍ইয়াউমুল জাঝা 'الیوم الجزأ' (অর্থঃ পুরস্কারের দিবস) হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর আল্লাহর নির্দেশে আমরা এদিনে রোজা ভঙ্গ করি বলে এ দিনটির নাম ঈদুল ফিতর।



ঈদের আর একটি অর্থ ফিরে আসা, বার বার আসা। আর ফিতর অর্থ ভঙ্গ করা। যেহেতু ঈদুল ফিতর প্রতি বছরই যথাসময়ে আমাদের মাঝে বার বার ফিরে আসে। এ দিনটিতে আমরা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সম্ভোগে লিপ্ত না হওয়ার যে বিধান ছিল তা ভঙ্গ করি বলে এদিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়েছে।



উদযাপনের সংস্কৃতিঃ



আমরা আমাদের দেশের ঈদুল ফিতর বা ঈদ উদযাপন সমন্ধে জানতে যেয়ে যদি গোড়ার নিকে লক্ষ্য করি তাহলে যে তথ্য-উপাত্যগুলি খুঁজে পাই তা হচ্ছে, মোগলদের আগমনের আগে বাংলায় ঈদের দিনের খুব একটা মর্ম ছিল না। মোগলরা আসার পর থেকেই ঈদকে উৎসব রূপে দেখতে পায় উপমহাদেশের সব মুসলিম। আগে ঈদুল ফিতর উল্লেখিতভাবে পালন না করার পেছনে কিছু কারণ খুঁজে বের করেন বিশিষ্ট লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন। তার কথা মতে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসিত তখনকার সমাজে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব বড়দিনকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হতো। খুব ধুমধাম করে পালন করা হতো বড়দিন বা ক্রিসমাস। এই দিনে সরকারি ছুটিরও ব্যবস্থা ছিল। কলকাতার বাইরে মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যদিও এই অনুষ্ঠানের কোনো যোগসূত্র ছিল না। তখন উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের সমপরিমাণ খ্রিস্টানও ছিল। আর ব্রিটিশদের শাসনামল ছিল বিধায় খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবগুলোই পালন করা হতো। সে সময় খুব জমকালোভাবে হিন্দু ধর্মের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা পালন করা হতো। মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ। তাই তাদের ধর্মীয় উৎসবের মর্যাদাও ছিল কম। ঈদের ছুটির তুলনায় পূজার ছুটি ছিল বেশি। ঈদের ছুটি বাড়ানোর আবেদন করলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি সে যুগের মুসলমানরা।

ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য নিম্নবিত্ত মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে হালকা আনন্দ-উৎসবের ব্যবস্থা করত। তাছাড়া তখন সাধারণ মানুষের ধর্ম এবং ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে জানা ছিল খুব কম। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ উদযাপিত না হওয়ার পেছনে আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। এসব ক্ষেত্রেও মোগলদের অনেক বড় অবদান রয়েছে। মোগলরা প্রত্যেক প্রদেশে মক্তব গড়ে তুলেছিলেন সঠিক কোরআন ও ইসলামী আইন শিক্ষা দেয়ার জন্য। সেই চারশ’-পাঁচশ’ বছর আগে উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মকে সঠিক রূপে প্রচার করেন মোগলরাই।





মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে চাঁদপুর, ঝিনাইদহ, বরগুনার বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে একই দিনে কিছু মুসলিম(!) উদযাপন করে পবিত্র ঈদ উল ফিতর। ৮৮ বছর পূর্বে দেশে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ৭নং বড়কুল পশ্চিম ইউনিয়নের সাদ্রা দরবার পীর মরহুম মাওলানা আবু ইছহাক সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ইসলামের সব ধর্মীয় রীতিনীতি প্রচলন শুরু করে। সেই থেকে দেশের সব মানুষের একদিন আগে তারা ঈদের নামাজ আদায় করে। বিষয়টি যেমন অযৌক্তিক তেমনি ফেতনা সৃষ্টিকারী। একটা সাধারণ বিষয় লক্ষ্য করলে তো এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। সেটি হলো সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সময়ের পার্থক্য কতটুকু? ওখানে যখন সেহরি খায় আমরা কী তখন সেহরি খাই? সৌদিতে যখন ইফতার করার সময় হয় তখন আমাদের কোন সময় হয়? সৌদি আরবের লোকজন কা'বা শরীফে চতুর্দিক নামাজ পড়েন, অথচ আমরা শুধু পশ্চিম দিকেই নামাজ পড়ি। কা'বার পশ্চিমের মুসলিমগণ পূর্ব দিক হয়ে নামাজ পড়েন। সুতরাং নিজস্ব অনুসারী তৈরী ও আলোচনায় আসার জন্য ফেতনা তৈরী করা জ্ঞানপাপীর কাজ। আর ইসলাম এ পৃথিবীতে এসেছে একতাবদ্ধ করার জন্য। বিচ্ছিন্নতা তৈরীর জন্য নয়। তাই যারা স্থানীয় মানকে অস্বীকার করেন তাদের নিকট আহ্বান, আসুন যে ইসলাম বলেছে কুল্লু মুসলিমুন ইখওয়াতুন। সেই ইসলামের ঐক্যতে একতাবদ্ধ হই। মন যা চায় তা পরিহার করি।


ঈদুল ফিতর উৎসব কাতারেঃ



কাতারের অধিবাসীগণ তিন দিন ধরে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। সাজগোজ করে ছুটির দিনটিকে স্বাগত জানাতে তৈরি হয় তারা। মহিলারা তাদের শরীর পরিষ্কার করে এবং হাত-পায়ে মেহেদি লাগায়। কাতারে এই রেওয়াজটি এত নৈমিত্তিক যে নতুন চাঁদ দেখার ব্যাপারটিকে প্রায়ই ‘মেহেদি রাত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মহিলারা তাদের সংগৃহিত নতুন জুতো আর প্রায়শই সোনালি বা রুপালি সুতোয় নকশা করা কাফতান পরে। পুরুষরাও শরীরে সৌরভ মাখে বা পোশাকে আতর লাগায়।


বাচ্চারা ঈদের গান গায়, বাবা-মা এবং প্রবীণরা বাচ্চাদের ঈদের সালামি ও খাবার দিয়ে থাকে। নামায ও নাশতার পর দিনের বাকি অংশ পরিবারের সঙ্গে দেখা করার ভেতর আবর্বিত হতে থাকে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীরা ঘন ঘন উপহার হিসেবে মিষ্টি খাবার বিনিময় করে। রাজধানী দোহায় বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে তলোয়ার যুদ্ধ ও ঢোল বাজানোর মাধ্যমে জনতাকে আমোদ জোগানো হয়। আতশবাজি পোড়ানো সন্ধ্যায় দর্শকদের চমকিত ও অনন্দিত করে তোলে।



দ্বীপ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াঃ



অস্ট্রেলিয়ায় মুসলিমরা নিজেদের মতো করে ঈদ উদযাপন করেন। বড় কোম্পানিগুলো মুসলিমদের ঈদের জন্য ছুটি দিয়ে থাকে। মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মসজিদে নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। অনেক সময় তা মসজিদ ছাড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। 



ভারত ও পাকিস্তানঃ



চাঁদরাতে ভারত ও পাকিস্তানে মেয়েরা হাতে মেহেদী লাগান।

ভারত ও পাকিস্তানে ঈদের আগের রাতকে ‘চাঁদ রাত’ বলা হয়। চাঁদ রাতে এসব দেশে অনেকেই কেনাকাটা করতে যান। এর মজাই আলাদা। চাঁদরাতে মুসলমানদের বাড়িগুলোতে চলে ঈদের রান্নাবান্নার আয়োজন। মেয়েরা অনেকে হাতে মেহেদির কারুকাজ করতে ব্যস্ত হয়েছে পড়েন। ঈদের দিন নতুন পোশাক পরে ‘ঈদ মোবারক’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। চলে কোলাকুলি করে হৃদ্যতা-বিনিময়। ঈদের দিন বড়দের সালাম করে ছোটরা পায় সালামি বা ঈদি। ধনাঢ্য পরিবারগুলো নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী জাকাত আদায় করে থাকে। ভারতে ঈদ উপলক্ষে এক দিনের সরকারি ছুটি থাকে। নয়াদিল্লিতে জামে মসজিদ, হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদে, লক্ষ্নৌতে আছে শবাগ ঈদগাহে, কলকাতায় রেড রোডে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। এ সময় অমুসলিম প্রতিবেশী ও বন্ধুরাও মুসলিমদের ঈদের শুভেচ্ছা জানান। ভারতের হায়দরাবাদে জাঁকজমকভাবে ঈদ উদযাপন করা হয়।

নতুন সিনেমা মুক্তি না পেলে ভারতীয়দের কাছে ঈদই যেন পানসে মনে হয়। তাই তো প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকার বলিউড সিনেমা নির্মিত হয় শুধুমাত্র ঈদকে সামনে রেখে।

পাকিস্তানে শিশুদের জন্য দিনভর খোলা থাকে বিভিন্ন খাবার ও খেলনার দোকান। অনেকে পার্ক ও সাগর তীরের মতো মনোরম স্থানে বেড়াতে যান।



ফিলিস্তিনঃ



নিজদেশে পরবাসী পৃথিবীর সবথেকে অত্যাচারিত মানবগোষ্টী ফিলিস্তিনিগণ

ঈদের দিন জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদের কাছে কবরস্থানসহ অন্যান্য কবরস্থানগুলো জিয়ারত করে ফিলিস্তিনিরা।



পিরামিডের দেশ মিসরে ঈদের সংস্কৃতিঃ


মিসরে তিন দিন ধরে ঈদের উৎসব উদযাপিত হলেও দেশটিতে এক দিনের জন্য সরকারি ছুটি থাকে। এই দিনে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস এমনকি কিছু দোকান ও খাবারের দোকান বন্ধ থাকে। ঈদের পরের দুই দিন অনেকে পার্কে বা অন্য কোনো জায়গায় বেড়াতে যায়। অনেকে নীলনদ ভ্রমণে বের হয়। অনেকে সিনাই উপত্যকায় শারম এল শেখ শহরে ছুটি কাটাতে যায়। শিশুদের দেয়া হয় নতুন পোশাক। মা, স্ত্রী, বোন ও মেয়েরা তাঁদের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে বিশেষ হাদিয়া পেয়ে থাকেন। ছোটরা বড়দের কাছ থেকে হাদিয়া পায়, যাকে  ঈদ-ইএ-ইয়াহ বলা হয়। মিসরের দালগামোন গ্রামে ঈদের দিন মানুষজন মৃত স্বজনদের কবর জিয়ারত করে থাকেন।



আফগানিস্তানঃ



আফগানিস্তানে ঈদ উৎসব পালনের জন্য ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। পুরুষদের জন্য খোলা কোনো ময়দানে তখম-জাঙ্গির আয়োজন করা হয় যেখানে তারা পরস্পরের দিকে সেদ্ধ করা ডিম ছুড়ে মারে। 



ইরানঃ


শিয়াদের অধ্যুষিত ইরানে ঈদ উদযাপন হয় অনেকটা নীরবে। অনুষ্ঠানের ঘটা থাকে ব্যক্তিগত সব আয়োজনে। ঈদে দান করাটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রতিটি পরিবার গরিবদের মধ্যে খাবার বিলিয়ে থাকে। ধনীরা অনেকে এই দিনে ত্যাগের মহিমায় গরু বা ভেড়ার গোশত গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে থাকে। ইরানী মসজিদ গুলোতে ঈদুল ফিতের নামাজ পড়ার জন্য কালো বোরখা ও হিজাবের মহিলাদের জয় জয়াকার। পুরুষদের থেকে নারীরা বেশী উদযাপন করে এই ঈদুল ফিতর। রাস্তায় জাকাত ও ফিতরা প্রদান করার বাক্স বসানো থাকে।


তুরস্কঃ



‘সেকের বায়রামি’, আমরা যাকে ঈদ বলি তুর্কিরা তাকে এই নামেই চেনে। বাচ্চারা প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায়।



সৌদি আরবঃ



শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ সৌদি আরবে খুব আন্তরিক উপায়ে ঈদ-উল-ফিতর পালন করা হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য শহর জুড়ে আতশবাজির খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। খুব একটা খরচাপাতি না করেও যে একটি উৎসব সবার মন ছুঁয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে সৌদি আরবে।



সংযুক্ত আরব আমিরাতঃ



মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনীক রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদ মানে হাজারো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চমৎকার সব নাটক বা শো এবং অভাবনীয় অফারের ছড়াছড়ি। রণ-পা, নৃত্যশিল্পী, ভাঁড়, জাদুকর, বেলুনওয়ালা দিয়ে ভরে যায় এখানকার রাস্তাগুলো।



চীনে ঈদুল ফিতরের সংস্কৃতিঃ



ঈদ উপলক্ষে বৌদ্ধদের দেশ চীনের মুসলিম এবং অমুসলিম উভয়ের জন্যই ২-৩ দিনের সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। সকালবেলা ঈদের নামাজ শেষে চাইনিজ মুসলিমরা পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রোমন্থন করে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিলি করে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থাও করা হয় এই দিনটিতে।



মালয়েশিয়াঃ



ঈদের দিন আপামর জনতা ঘরের দুয়ার খুলে অভ্যর্থনা জানায় মালয়েশিয়ার প্রতিটি নাগরিককে। ঘরের সামনে পেলিতা নামক মোম জ্বালিয়ে ঈদের শোভা বাড়িয়ে তোলে মালয়েশিয়ানরা। আতশবাজির মনোমুগ্ধকর খেলার সাথে প্রায় ২-৩ দিন ধরে ঈদ আয়োজন চলতে থাকে মালয়েশিয়ায়।






খাদ্য উপাদানঃ

উৎসব বা আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ খাবার গ্রহণ। মহান রবের দেয়া সন্তুষ্টির এই দিনে সারা বিশ্বের মুসলিমগণ তাদের সাধ্যমত নিজস্ব রুচি ও স্বকীয়তার মধ্যে মুখরোচক নানা খাদ্য উপাদান তৈরী করেন। প্রিয়জন, গরিব-দুঃখীসহ অন্যান্যদের মাঝে তা বিতরণ করেন। আসুন জেনে নেই মুসলিম বিশ্বের কতিপয় দেশের ঈদুল ফিতরের খাদ্য উপাদানের রকমফের।




মরক্কোঃ লাসিদা ও তাজিন


মরক্কোতে ঈদুল ফিতরের সকাল বেলা সকলেই লাসিদা দিয়ে নাস্তা করে। লাসিদা দেখতে ভাতের পুটিং এর মতো কিন্তু এখানে কসকস, ঘি, মধু ও ফোড়ন থাকে। সকালটা লাসিদা দিয়ে শুরু হলেও বিকেলের দিকে তাজিন খাওয়ার ধুম পড়ে। উত্তর আফ্রিকান দেশগুলোতে এই তাজিন খুবই জনপ্রিয় একটা খাবার। ছাগলের গোশতের তাজিন শুষ্ক ফলাহারের চেয়ে মজাদার।



ইন্দোনেশিয়াঃ ল্যাপিস লেগিত, কেতুপাত, দোদোল, লেমাং ও নয়োনয়া



ডাচদের উপনিষদ থাকার কারণে তাদের থেকে প্রাপ্ত ঐতিহ্য ইন্দোনেশিয়া ধরে রেখেছে। রমজানের শেষ উপলক্ষে হাজার স্তরের সুস্বাদু এক ধরণের পিঠা তৈরী করে ইন্দোনেশীয়গণ ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। এই বিশেষ ধরনের পিঠাটি ল্যাপিস লেগিত নামে পরিচিত। এটা নেদারল্যান্ডে খুবই জনপ্রিয় 'আলবেইত' স্থানীয় নামে। ল্যাপিস লেগিত এর তৈরী পদ্ধতি বেশ জটিল। এক একটি স্তর ময়দা দিয়ে বিভাজন করা। এছাড়াও ঈদের দিনের বিশেষ খাবার হিসেবে রান্না করা হয় কেতুপাত, দোদোল, লেমাং (বাঁশের ভেতরে বানানো চালের পিঠা) ও নয়োনয়া।


আফগানিস্তানঃ বোলানি



আফগানিস্তানে মূলত ঈদুল ফিতরে শিশুরা বেশী আনন্দ উপভোগ করে। পরিবারের বয়স্ক সদস্যগণ শিশুদের জন্য নানা পদ তৈরী করেন। আফগানিস্তানের ঈদুল ফিতরের সবথেকে আকর্ষণীয় ও প্রায় প্রধান খাবার বোলানী। একটা সমতল রুটিতে পালঙ শাক, টমেটো, কুমড়ো ও ডালের সবুজ কিছু পাতা বা শাক দিয়ে তৈরী বোলানি। বোলানি যেমনি রসালো তেমনি মজাদার ও মুখরোচক।



ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন, মিসর ও ইরাকঃ

মাখন বিস্কুট



আমরা এগুলোকে মাখন বিস্কুট বলি। তবে এগুলো প্রায় ইংরেজি নামের মতই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ফিতিস্তিন, সিরিয়া ও লেবাননে খুবই প্রিয় খাবার এই বিশেষ ধরনের মাখন বিস্কুট। ফিলিস্তিনিদের নিকট এটা গেরেইবেহ্ নামে পরিচিত। কাজুবাদাম বা পাইন বাদাম দিয়ে তৈরী এই মাখন বিস্কুট। সিরিয়ায় ও লেবাননে এই মাখন বিস্কুট ম্যামৌল নামে পরিচিত। আখরোট বা খেজুর দিয়ে তৈরী হয় এই ম্যামৌল। ইরাকে ক্লেইচা নামে অভিহিত এই মাখন বিস্কুট। মিসরে এ ধরনের বিস্কুটকে বলা হয় কাখ যা লেবানিজ মতো রন্ধন প্রণালীতে প্রস্তুত হয়। এছাড়াও ঈদে রান্না করা হয় প্রিয় খাবার ফাতা। উপর্যুক্ত ধরনের বিস্কুটই হচ্ছে এই দেশগুলোর ঈদুল ফিতরের প্রধান খাদ্য উপাদান।



দ্বীপরাষ্ট্র কাতারঃ বুলালিত, বাকভালা ও কফি



মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কাতারে ঈদুল ফিতরের প্রথম সকাল শুরু হয় বুলালিত, ছুটির মিষ্টি রুটি আর অন্যান্য মিষ্টি খাবার দিয়ে বিশেষ নাশতা করে। বুলালিত সেদ্ধ ডিমে ঢাকা মিষ্টি নুডলসকে বলে। মেহমানদের দারুচিনি দেয়া কফি, গোলাপজলের সুবাসঅলা চা, বাকলাভা, ফল আর অন্যান্য মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। দুপুরের খাবার সময় বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা সদ্য জবাই করা ভেড়া আর ভাত খেতে কোনো প্রবীণ আত্মীয়ের বাড়িতে জড়ো হয়। প্রায়ই ২০ থেকে ৫০ জন লোকের এই বড় আকারের সমাবেশে একটা বিরাট টেবিলে খাবার রাখা হয় এবং লোকজন খাওয়ার জন্য মেঝেতে বসে। 



ইরানঃ বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন



গত ২০১২ সালে ইরানের ইমাম খোমেনী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছিলাম সেখানে। খুব সাদামাটা ও নিরুদ্বিগ্নভাবে এই একদিনের সরকারী ছুটির দিনে রাস্তায় রাস্তায় বিশেষ বিশেষ মিষ্টান্নের প্যাকেট থাকে। শিয়া অধ্যুষিত বলে এই ঈদুল ফিতরের জাঁকালো কোনো খাবারের আয়োজন ও অনুষ্ঠান দৃষ্টিগোচর হয়নি।



যুক্তরাজ্যঃ বিরিয়ানি



যুক্তরাজ্যে জনপ্রিয় ঈদের খাবার হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এক বিরিয়ানী। এই বিরিয়ানিতে গোশত ও পোলার চাউলের মিশ্রনে তৈরী হয় রসনাকে উপাদেয় উচ্চস্বাদের এক উৎসবি খাবার। বেশী বেশী মসলার ব্যবহার হয় এই বিশেষ বিরিয়ানিতে। সধারণত মুরগী এই বিরিয়ানিতে ব্যবহৃত হয়না। তবে খাশি, ভেড়া বা ছাগল এমনকি মাছ ও কিছু কিছু থাকে। উক্ত বিরিয়ানির সাথে রাইটা(শশা, পুদিনা ও লাচ্ছির সমন্বয়ে তৈরী) পরিবেশন করা হয়। প্লেটের চারপাশে সালাদ ও কাসুন্দি দেয়া হয়।



মালয়েশিয়াঃ রেনদাঙ্গ



ঈদের দিনের বিশেষ খাবার হিসেবে রান্না করা হয় কেতুপাত, রেনদাঙ্গ, দোদোল, লেমাং (বাঁশের ভেতরে বানানো চালের পিঠা) ও নয়োনয়া। এ ধরনের খাবার ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি রাষ্ট্রেও প্রচলিত।



চীনঃ ইউ জিয়াং



চিনে উইঘুর সম্প্রদায়সহ অন্যান্য মুসলিমগণ রমজান শেষের খুশির ঈদুল ফিতরে ইউ জিয়াং নামক এক প্রকার খাদ্য উপাদান ভক্ষণ করে থাকেন। প্রায়ই স্যুপের সাথে পরিবেশন করা হয় এই সুগন্ধি তৈলাক্ত মুখরোচক উপাদেয়টি। ইউ জিয়াং ময়দা দিয়ে তৈরী হয়। মুরব্বীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে ইউ জিয়াং খেতে দেয় চীনে।



রাশিয়াঃ মান্টি


মসলা দিয়ে রসালো করে মাখানো এক ধরনের খাবারের নাম মান্টি। ভেড়া বা খাশির গোশত দিয়ে রাশিয়ান এক বিশেষ ধরনের খাদ্য উপাদান মান্টি তৈরী করে ঈদুল ফিতর উদযাপনের প্রধান খাদ্য সামগ্রী হিশেবে। মজাদার এই খাবার যদি আমরা খাই তবে আমরা বারবার খেতে চাব। সারা বিশ্বে এই বিশেষ মান্টি এর সুনাম আছে। 



সোমালিয়াঃ



সোমালিয়াতে ঈদুল ফিতরের প্রধান খাদ্য সামগ্রী হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি হালভো। হালভো বানানো হয় তেল, চিনি, কর্নস্টার্চ এবং হরেক রকমের মসলা মিশিয়ে।


ইয়েমেনঃ আসিদা



মাঝে মাঝে এই বিশেষ খাবারটির নাম আসিদও বলা হয়। এই ইয়েমেনি মিষ্টান্ন মোরব্বাটি মেক্সিকোর ফ্লানের মতো নয়। সৌদি আরব, সুদান ও লিবিয়ায় এই আসিদা পাওয়া যায়। আসিদা প্রাথমিকভাবে গম ও মধু দিয়ে তৈরী হতো। সুদানীদের ঈদ উৎসব ছাড়াও অন্যান্য উৎসবে এই মজাদার খাদ্য উপাদানটির প্রচলন ব্যাপক। প্রতিবেশীদের মাঝে এই খাবারটি বিতরণ করে। এই আসিদা সিদ্ধ হওয়ার পর দ্রুতই খেতে হয়। বিন্ট আলসাহানও ইয়েমেনে খুবই পরিচিত একটি ঈদুল ফিতর উৎসবের খাদ্য পদ।



মরিশাসঃ



আফ্রিকা মহাদেশের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মরিশাস। অনেক মুসলিমের বসবাসকারী এই মরিশাসে ঈদ উদযাপিত হয় অনেকটা সাদামাটাভাবে। ঈদুল ফিতরের প্রধান আকর্ষণ থাকে বিরিয়ানি। নামাজ শেষে পরস্পর 'ঈদ মোবারক' বলে কোলাকুলি করে বাটিভর্তি বিরিয়ানি বিনিময় করে মরিশাসের মুসলিমরা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই একসাথে বসে দুপুরের খাবার খায়। 



ভারতঃ সেভিয়া, কোরমা



ভারতীয়দের কাছে ঈদ মানে যেন সেভিয়া খাওয়ার বাহানা, এই মিষ্টিটি ছাড়াও নানা পদের কাবাব, নেহারি, হালিম সহ হরেক রকমের মুখরোচক খাবারে সরগরম হয়ে থাকে ভারতের প্রতিটি ঘর।



আমাদের দেশ মাতৃকা বাংলাদেশঃ



সবশেষে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের ঈদুল ফিতরের খাদ্য উপাদান সম্পর্কে বলছি। সবাই জ্ঞাত যে, সকাল বেলা রসালো দুধের সেমাই দিয়ে ঈদের দিনের খাদ্যগ্রহণ শুরু হয়। নামাজ শেষে পোলাও, খিচুড়ি, বিরিয়ানি ইত্যাদি পরিবেশন হয় ঘরে ঘরে। দেশের অনেক জায়গায় সম্মিলিতভাবে গরু বা খাশি জবাই করে গোশত বন্টন করে নিয়ে ঈদুল ফিতরের আপ্যায়ন ও নিজেরা ভুরি ভোজন করে।


তথ্য সূত্রঃ

১. www.theculturetrip.com ,

২. আল জাজিরা,

৩. আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম ট্র্যাডিশন : তানিয়া গুলেভিচ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সংস্কৃতি বিষয়ক ফিচার।




মীম মিজান


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

Advertisement