বিজ্ঞাপন

রাজকুমারী ক্যালিপ্সো | শুভ্রা মুখার্জি


এক নদীর ধারে বাস করতো এক জেলে আর জেলেনী।তারা খুব গরীব মানুষ ।কিন্তু গরীব হলেও তাদের ভাঙা ঘরে শান্তি র অভাব ছিল না ।দুঃখ শুধু একটা ।তাদের কোন সন্তান নেই ।জেলেনী কত ঠাকুর দেবতাকে মানত পূজো করেছে কিন্তু কিছুই হয়নি ।


একদিন সকাল থেকে আকাশে র মুখ ভার ।মেঘ ঘনিয়ে এসেছে ।জেলেনীর মুখে সে মেঘের ভার নেমেছে ।মাছ ধরতে না পারলে আজ খাওয়া জুটবে না! গিন্নী র মুখ দেখে জেলে পরিস্থিতি বুঝে গেল।সে জাল নিয়ে বেরোনোর উদ্দেশ্য তৈরি হল।জেলেনী বলল'আজ আর বেরিয়ে কাজ নেই ।মনে হচ্ছে খুব জোরে তুফান আসছে 'জেলে বলল 'তুমি চিন্তা কোরো না ।আমি জেলের ছেলে। এসব ঝামেলা তো লেগেই আছে তাই না! 'এই বলে জেলে কাঁধে জাল ফেলে ডিঙি বেয়ে বেরিয়ে গেল ।সবে নদীতে জাল ফেলেছে হঠাৎই প্রবল ঝড়জল শুরু হয়ে গেল ।জেলে আর সাহস পেল না নদীতে থাকতে ।যা ঝড় জল!হয়তো ডিঙি টা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে ।সে ভাবল'ঘরে ফিরে যাই ।জেলেনী একা আছে'।
জেলে সবে জাল ডিঙি তে তুলেছে তখনই সে শুনতে পেল একটা শিশুর কান্না ।এই ঝড়ে জলে কার শিশু কাঁদছে! মা বাবার মনে হচ্ছে কোন খোঁজ নেই! কিন্তু আশেপাশে তো কোন শিশু কে দেখা যাচ্ছে না! তাহলে ব্যাপারটা কি হল?কি মনে করে জেলে তার জাল খুলে ফেলল।আরে একি!জালে আটকে রয়েছে একটি ছোট্ট শিশু!জেলে খুব তাড়াতাড়ি শিশুটাকে কোলে নিয়ে আদর করে ওর গা মোছাতে গেল ।কিন্তু একি!ও তো কোন সাধারণ মানুষের শিশু না!কোন জলপরী বা মৎস্যকন্যার বাচ্চা মনে হচ্ছে ।হম!ঠিক তাই! কারন ওর দুটো পা মানুষের পায়ের মত না।দুটো পা জুড়ে যেন লেজের আকার ধারণ করেছে ।মাথা থেকে কোমর অবধি স্বাভাবিক ।তারপর যেন মাছের লেজের আকার ধারণ করেছে ।
দেরী না করে জেলে শিশুটি কে বুকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির পথ ধরল ।তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে জোরে দরজা তে ধাক্কা দিল ।জেলেনী দরজা খুলে দিতেই সে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ।জেলেনী কিছু বলার আগেই শিশু টিকে জেলেনীর কোলে তুলে দিল।জেলেনী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শিশুর দিকে।কিন্তু চমকে গেল যখন তার পায়ের দিকে নজর পড়তে ।'ওকে কোথায় পেলে গো'?জেলে তার কাছে সব কিছু খুলে বলল ।আরো বলল'দরকারী জিনিস গুছিয়ে নাও ।আমরা আজ রাতে ই এই গাঁ ছেড়ে চলে যাব'।
সেদিন গভীর রাতে জিনিসপত্র গুছিয়ে শিশু টিকে বুকে করে জেলে আর জেলেনী রওনা দিল ।খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে তারা অন্য গাঁয়ে এসে হাজির হল ।সেখানে ই তারা সংসার পাতলো ।শিশুটিকে নিজের মেয়ের পরিচয় দিয়ে বড় করতে লাগল ।গাঁয়ের লোকজনের সাথে অল্পদিনেই মিলে মিশে গেল।সময় কারো জন্য বসে থাকে না ।দেখতে দেখতে কেটে গেল ষোলো টি বছর ।জেলে আর জেলেনী র পালিত শিশু আজ ষোলো বছরের নব যুবতী ।অপরূপ সুন্দরী মেয়ে ।জেলে আদর করে তার নাম রেখেছে 'ক্যালিপ্সো '।কিন্তু খুব কষ্টের কথা মেয়েটি মাথা থেকে কোমর স্বাভাবিক হলেও কোমরের নীচে র অংশ মাছের মত আকার ধারণ করেছে ।জেলেনী সবসময়ই তাকে পোষাক পরিয়ে রাখে।সে হাঁটতে পারে না ।তারা প্রতিবেশী দের বলেছে তাদের মেয়ে প্রতিবন্ধী ।হাঁটতে পারে না ।কিন্তু জেলে আর জেলেনী র সবসময়ই চিন্তা তাদের মৃত্যুর পর সুন্দরী ক্যালিপ্সো কে কে দেখবে!

একদিন সেই দেশের রাজপুত্র জঙ্গলে শিকার করতে এলেন ।জঙ্গলের পাশেই জেলের কুঁড়ে ।হঠাৎই রাজপুত্রের খুব জল পিপাসা পেয়ে গেল ।সেই সঙ্গে খিদে ।সমস্ত জঙ্গলে কোথাও জল বা খাবার না পেয়ে বেচারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল।তখনই তার চোখে পড়লো জেলের সুন্দর কুঁড়ে ঘর টি।সে সেই দিকে পা বাড়ালো ।জেলেনী তখন ঘরের সামনে লাগানো ফুলের গাছ গুলো র পরিচর্যা করছিল  আর জেলে মাছ ধরতে গেছিলো ।রাজপুত্র কে দেখে জেলেনী খুব আদর করে ঘরে বসতে দিল ।মিছরি ভিজিয়ে উঠনের গন্ধরাজ লেবু দিয়ে সরবত করে নিয়ে এল ।সমানে পাখা করতে লাগল রাজপুত্র কে।শরীর সুস্থ হল রাজপুত্রের ।হঠাৎই তার চোখে পড়ে গেলো ঘরের ভেতর বসে থাকা সুন্দরী ক্যালিপ্সো র ওপরে ।দেখা মাত্রই রাজপুত্র তাকে ভালোবেসে ফেলল ।জেলেনী কে বলল'আমি আপনার মেয়ে কে বিয়ে করতে চাই '।জেলেনী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল! দু চোখ তার জলে ভরে গেল ।চোখ মুছে জেলেনী বলল'সে তো খুব ভালো কথা।কিন্তু আমাদের মেয়ে যে একটু অন্যরকম।মানে ঠিক মানুষের মত না ।'রাজপুত্রের ভীষণ কৌতূহল হল।সে জেলেনীর সাথে ঘরের ভেতরে গেল।জেলেনী তাকে মেয়ে র পোষাক একটু তুলে লেজ দেখালো ।সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্র বুঝতে বাকি রইল না ক্যালিপ্সো আসলে মৎস্যকন্যা।তবু সে ক্যালিপ্সো কে বলে বসল যে সে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে আর তাকে বিয়ে করতে চায় ।একথা শুনে ক্যালিপ্সো ভীষণ অপমানিত বোধ করল ।তার ওরকম শরীর দেখে কি রাজপুত্র তামাশা করছে তার সাথে?ভীষণ অভিমানে ক্যালিপ্সো র চোখে জল এসে গেল ।সে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল আর খুব জোরে জোরে লেজ ঝাপটাতে লাগলো ।জেলেনী কত বোঝালো ।রাজপুত্র বারবার স্বান্ত্বনা দিতে লাগল ।কিন্তু কে শোনে কার কথা! সমানে সে লেজ ঝাপটে নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। হঠাৎই একটা ঘটনা ঘটে গেল ।ক্যালিপ্সোর লেজ ফেটে গিয়ে সেই জায়গা তে দুটো কচি অপুষ্ট পা দেখা গেল প্রচন্ড যন্ত্রণার কারনেই সে অচেতন হয়ে পড়ল।রাজপুত্র তাকে ধীরে ধীরে তুলে বিছানা তে শুইয়ে দিল আর রাজবাড়ি তে রাজবৈদ্য র কাছে খবর পাঠিয়ে দিল।রাজবৈদ্য এসে খুব ভালো করে দেখে বললেন 'হম ।ওই দুটি পা ই বটে ।তবে খুব দূর্বল ।ভালো করে যত্ন নিলে হাঁটতে শুরু করবে'।এই বলে তিনি তাঁর চিকিৎসা শুরু করলেন ।তাঁর চিকিৎসার গুনে আর রাজপুত্রের ভালোবাসা পেয়ে ক্যালিপ্সো খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেল ।ধীরে ধীরে তার পালিত বাবা মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখে গেল।অবশেষে একদিন শুভদিন দেখে রাজামশাই আর রানীমা জেলের কুঁড়ে তে এসে ক্যালিপ্সো কে আশীর্বাদ করে রাজপুত্রের সাথে তার বিয়ের দিন ঠিক করে গেলেন। আর কোন কষ্টই রইলো না জেলে আর জেলেনীর।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

Advertisement