বিজ্ঞাপন

শীতের পাখি | শেখ একেএম জাকারিয়া

 




মানুষসহ সচরাচর সব প্রাণীদেরই সীমান্ত রেখা থাকে। পাখিদের কোন সীমান্ত রেখা নেই। পাখিরা বাঁচার তাগিদে, খাদ্যের অন্বেষণে পাখিরা স্বচ্ছন্দে সীমাহীন অন্তরীক্ষে পাখনা মেলে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে উড়ে বেড়ায়। বড়ো বিস্ময়কর তাদের বাসা বুনার কৌশল, সন্তান জন্মদান ও লালনপালন। প্রচণ্ড ঝড়-বাদল, প্রখর সূর্যকিরণ, তুষারপাতসহ প্রকৃতির নানা প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে পাখিরা রওনা দেয় বহুসহস্র মাইল দূরের দেশে।

পাখি সম্পর্কে প্রাণিতত্ত্বে বিশদ বিবৃতি রয়েছে। পাখির সহজবোধ্য সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘সচরাচর উড়তে পারে এমন, পালকে আবৃত দেহ, তীক্ষ দৃষ্টি ও প্রখর শ্রবণ শক্তিসম্পন্ন উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট ডিম্বাজ মেরুদণ্ডী প্রাণি বিশেষই পাখি। অথবা দুই ডানা ও দুই পা-যুক্ত এবং সাধারণত আকাশে ওড়ার ক্ষমতাযুক্ত ডিম প্রসবকারী প্রাণীই পাখি। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পাখির বিভিন্ন নাম দেখতে পাওয়া যায়। তারমধ্যে পক্ষী, বিহগ, বিহঙ্গ, খগ ইত্যাদি উল্লেখ্য। প্রাণিতত্ত্বের হিসাব মতে, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতির পাখিই (প্রায় ১৯%) পরিযায়ী। ভারত উপমহাদেশে এ সময়ে ২ হাজার ১শ’ প্রজাতির পাখি আছে। যাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩শ’ প্রজাতির পাখি শীত ঋতু আগমনের পূর্বে হেমন্ত ঋতুর প্রায় মধ্যভাগে ভারতের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত হিমালয়সহ অন্যান্য ছোটোখাটো পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে আমাদের দেশে উপস্থিত হয়। এসব পাখিদের আমরা পরিযায়ী পাখি, শীতের পাখি, অতিথি পাখি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকি। সাধারণভাবে পরিযায়ী পাখির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখতে হয়,’শীতঋতুতে অস্থায়ী বসবাসের জন্য উষ্ণতর দেশে গমন করে এমন পাখি, পরিযায়ী পাখি।

এ দেশে মৃদু হাওয়ায় যে সময়ে শীতের আভাস দেখা দেয় সে সময়ে হাওর-বাঁওড়, খালবিল, চরাঞ্চালে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মিলে। এসব পাখির অর্ধেকের বেশি ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশায়ার, সাইবেরিয়া, এন্টার্কটিকার শীতাধিক্য থেকে নিজেদের বাঁচাতে এবং আহারের খোঁজে চলে আসে আমাদের দেশসহ অপরাপর কম শীতের দেশগুলোতে। তাছাড়া মঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াং, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ শীতপ্রধান অঞ্চল থেকেও আসে নানাপ্রজাতির পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী পাখি সাধারণত সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের দিকে আমাদের দেশে দলবেঁধে আসা শুরু করে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসব অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সবুজ হলুদ ছায়াঘন রূপসী বাংলার নয়ন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে আমাদের বাংলাদেশে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এসব পরিযায়ী পাখি তাদের গমনের লক্ষ্যস্থল শতভাগই ঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারে। শীতঋতু এলেই অতিথি পাখির মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে দি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খ্যাত সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের নয়কুড়ি কান্দা, ছয়কুড়ি বিল মুখরিত হয়ে ওঠে। অতিথি পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পাখি হচ্ছে জেন্ডা সিগলা (জাডানিক) বা সরালী হাঁস। কালচে, বড় ও লম্বা গলার এ হাঁস দেখতে অবিকল দেশীয় পাতিহাঁসের মতো। টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ে বসবাসরত লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যায়, সরালী হাঁস দিনের প্রথমভাগে ও শেষভাগে দলবেঁধে হাওর জলে সাঁতার কাটে ও মাছ ধরে। দিনের হালকা মিষ্টি রোদ এদের খুব প্রিয়। নৈসর্গিক বিপর্যয় বা শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য যেসব পাখি প্রতিবছর বহু সহগ্র মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে বিপদহীন বাসস্থানের খোঁজে, যেসব পাখি খাদ্যের নিশ্চিত সন্ধান, সন্তান জন্মদানের জন্য আপন করে বেছে নেয় বাংলার সবুজ ছায়াঘন সুনির্মল প্রকৃতি, সেখানেও বাজপাখির মতো প্রখর দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন শিকারির হাত থেকে বাঁচার সৌভাগ্য তাদের অনেক সময়ই হয় না।

শিকারির বন্দুকের গুলিতে অথবা শিকারির ফাঁদে প্রাণ হারাতে হয় নিজেদের অথবা তাদের স্বজনদের। প্রাণ হারানোর এমন আতঙ্ক সবসময় তাদের বিচলিত রাখে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের দরিদ্র লোকজন অভাবের তাড়নায় পাখি শিকার করে শহরে, গ্রামে-গঞ্জের বাজারে কিংবা রাস্তা-ঘাটে বিক্রি করছে কিন্তু যারা কিনছে তারা শহরের শিক্ষিত ও বিত্তশালী। এই যে অবাধে আমাদের দেশে পাখি শিকার ও ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এসব কিন্তু আদতে প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য নয়, শুধুমাত্র রুচির পরিবর্তনের জন্যই তারা নিজেরা শিকার করে অথবা কিনে নেয় নানারকমের পরিযায়ী পাখি। একটা লেনজা কিংবা একটা সরালী হাঁসে আর কতটুকুইবা মাংস হয়? এসব পরিযায়ী পাখি ব্যাতিরেকেও প্রোটিনের চাহিদা মেটানো কিংবা রুচির পরিবর্তন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা ও নিসর্গের প্রতি অনুরাগই সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে। পাখি শিকারের মতো নিষ্ঠুর কাজ বন্ধ করতে হলে আমাদের গণসচেতনতা বাড়ানো খুবই জরুরি। এর জন্য পত্র-পত্রিকায় নিউজসহ রেডিও-টেলিভিশনে বিবিধ ডকুমেন্টারি প্রচার করা উচিত।

পরিযায়ী পাখির জন্য সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়াশ্রম থাকার কথা। কিন্তু বস্তুত অভয়াশ্রম বলতে যা বুঝায় তা আজ অবধি সম্পূর্ণরূপে গড়ে উঠেনি। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী পাখি শিকার ও হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। শীতের শুরুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অতিথি পাখি হত্যা, জাল ব্যবহার ও শিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আইনগত কার্যকারিতা দেখায়। পরিতাপের বিষয়, কয়েক দিনের মধ্যেই এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। কিন্তু কেন এ তৎপরতায় এই ভাটা, এর ঠিক জবাব আমার জানা নেই।

সবুজ হলুদ ছায়াঘন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ, পাখির দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ বাংলাদেশ পেয়েছে অতিথি পাখিসমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিশেষ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

Advertisement